কারো বাড়িতে প্রবেশ করার আদব
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১১ এএম
হে ঈমানদারগণ! নিজেদের গৃহ ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না গৃহবাসীদের সম্মতি লাভ করো এবং তাদেরকে সালাম করো। এটিই তোমাদের জন্য ভালো পদ্ধতি, আশা করা যায় তোমরা এদিকে নজর রাখবে। তারপর যদি সেখানে কাউকে না পাও, তাহলে তাতে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না তোমাদের অনুমতি দেয়া হয়। আর যদি তোমাদের বলা হয়, ফিরে যাও তাহলে ফিরে যাবে, এটিই তোমাদের জন্য বেশী শালীন ও পরিচ্ছন্ন পদ্ধতি এবং যা কিছু তোমরা করো আল্লাহ তা খুব ভালোভাবেই জানেন। তবে তোমাদের জন্য কোন ক্ষতি নেই যদি তোমরা এমন গৃহে প্রবেশ করো যেখানে কেউ বাস করে না এবং তার মধ্যে তোমাদের কোন কাজের জিনিস আছে তোমরা যা কিছু প্রকাশ করো ও যা কিছু গোপন করো আল্লাহ সবই জানেন। (সুরা নুর ২৭-২৯)
কালজয়ী আদর্শ ইসলাম। মানুষের জীবন-মৃত্যু, শয়ন-জাগরণ, লেন-দেন, সম্পর্ক-সম্মন্ধ, বন্ধুত্ব ও বৈরিতা, অর্থনীতি ও সামাজিক আচার-আচরণ তথা সামগ্রীক জীবন পরিচালনার জন্য ইসলামের রয়েছে স্বতন্ত্র ও সুন্দর পদ্বতি। মানুষের নৈতিকতা, সামাজিক শৃংখলা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম যথাযথ বিধান দিয়েছে। যে সমস্ত বিধান সমাজকে অনাচারের উৎপাদন ও তার বিস্তার থেকে সংরক্ষণ করে।
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসাবে প্রত্যেকেই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যোগাযোগের অপরিহার্যতা প্রত্যাশিত। প্রতিবেশী ছাড়াও দুরের ও কাছের আপনজনদের সাথে কতই-না-ঘটনা বা বিষয় নিয়ে যোগাযোগ করতে হয়। সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি লোক সুখ-দুঃখ বিষয় নিয়ে অন্যের বাড়ি পর্যন্ত যেতে হয়। তাই ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ও কালজয়ী আদর্শ হিসাবে অন্যের বাড়ীতে প্রবেশের জন্যও সৌজন্যতা, ভদ্রতা ও আদব শিক্ষা দিয়েছে। এ আদর্শ সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন। উলেøিখত আয়াতটিতে কারো বাড়িতে প্রবেশের একটি পূণাঙ্গ ধারণা পাই।
এ আয়াতটির ব্যাখ্যায় বিভিন্ন মুফাস্সির ও ফিকাহবীদগণ বলেছেন যে, জাহেলী যুগে আরববাসীদের নিয়ম ছিল, তারা সুপ্রভাত, শুভ সন্ধ্যা বলতে বলতে নিসংকোচে সরাসরি একজন অন্যজনের গৃহে প্রবেশ করে যেতো। অনেক সময় বহিরাগত ব্যক্তি গৃহ মালিক ও তার বাড়ির মহিলাদেরকে বেসামাল অবস্থায় দেখে ফেলতো। আল্লাহ এর সংশোধনের জন্য এ নীতি নির্ধারণ করেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যেখানে সে অবস্থান করে সেখানে তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার অধিকার আছে এবং তার সম্মতি ও অনুমতি ছাড়া তার এ গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা অন্য ব্যক্তির জন্য জায়েজ নয়। আয়াত ও নবী সাঃ এর বাণীর আলোকে মুফাস্সির ও ফকিহগণ নিম্নলিখিত রীতিনীতি ও নিয়মগুলো প্রণয়ণ করেছেন:-
এক ঃ নবী সা. ব্যক্তিগত গোপনীয়তার এ অধিকারকে কেবলমাত্র গৃহের চৌহদ্দীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনন্ িবরং একে একটি সাধারণ অধিকারে গণ্য করেন। এ প্রেক্ষিতে অন্যের গৃহে উঁকি ঝুঁকি মারা, বাইর থেকে চেয়ে দেখা এমনকি অন্যের চিঠি তার অনুমতি ছাড়া পড়ে ফেলা নিষিদ্ধ। হযরত হুযাইল ইবনে শুরাহবীল বলেন, এক ব্যক্তি নবী সঃ কাছে এলেন এবং ঠিক তাঁর দরজার ওপর দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলেন। নবী সা. তাকে বললেন, “পিছনে সরে গিয়ে দাঁড়াও, যাতে দৃষ্টি না পড়ে সে জন্যই তো অনুমতি চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (আবু দাউদ) নবী সা. নিজের নিয়ম ছিল এই যে, যখন কারোর বাড়িতে যেতেন, দরজার ঠিক সামনে কখনো দাঁড়াতেন না। কারণ সে যুগে ঘরের দরজায় পরদা লটকানো থাকতো না। তিনি দরজার ডান বা বাম পাশে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইতেন। (আবু দাউদ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবী সা. বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া তার পত্রে চোখ বুলালো সে যেন আগুনের মধ্যে দৃষ্টি ফেলছে। (আবু দাউদ)
বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত হয়েছে, নবী সা. বলেছেনঃ “যদি কোন ব্যক্তি তোমার গৃহে উঁকি মারে এবং তুমি একটি কাঁকর মেরে তার চোখ কানা করে দাও, তাহলে তাতে কোন গোনাহ হবে না।”
ইমাম শাফঈ এ হাদীসকে একদম শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং তিনি কেউ ঘরের মধ্যে উঁকি দিলে তার চোখ ছেঁদা করে দেবার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু ইমাম আবু হানাফী এর অর্থ নিয়েছেন এভাবে যে, নিছক দৃষ্টি দেবার ক্ষেত্রে এ হুকুমটি দেয়া হয়নি। বরং এটি এমন অবস্থায় প্রযোজ্য যখন কোন ব্যক্তি বিনা অনুমতিতে গৃহে প্রবেশ করে, গৃহবাসীদের বাধা দেয়ায়ও সে নিরস্ত হয় না এবং গৃহবাসীরা তার প্রতিরোধ করতে থাকে। এ সংঘাতের মধ্যে যদি তার চোখ ছেঁদা হয়ে যায় এ জন্য গৃহবাসীরা দায়ী হবে না। (আহকামুল কুরআন-জাসসাস)
দুই : ফকীহগণ শ্র্বণ শক্তিকেও দৃষ্টিশক্তির হুকুমের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন অন্ধ ব্যক্তি যদি বিনা অনুমতিতে আসে তাহলে তার দৃষ্টি পড়বে না ঠিকই কিন্তু তার কান তো গৃহবাসীদের কথা বিনা অনুমতিতে শুনে ফেলবে। এ জিনিষটিও দৃষ্টির মতো ব্যক্তিগত অধিকারে অবৈধ হস্তক্ষেপ।
তিন : কেবল অন্যের গৃহে প্রবেশ করার সময় অনুমতি নেবার হুকুম দেয়া হয়নি বরং নিজের মা-বোনদের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি নিতে হবে। এক ব্যক্তি নবী সা. কে জিজ্ঞেস করলো, আমি কি আমার মায়ের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি চাবো? জবাব দিলেন হাঁ। সে বললো আমি ছাড়া মায়ের খেদমত করার মতো কেউ নেই। এ ক্ষেত্রে কি আমি যতবার তাঁর কাছে যাবো প্রত্যেকবার অনুমতি নেবো? জবাব দিলেন, ‘তুমি কি তোমার মাকে উলংগ অবস্থায় দেখতে পছন্দ কর?’ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন : নিজের মা বোনদের কাছে যাওয়ার সময় অনুমতি নাও।’
চার : শুধুমাত্র এমন অবস্থায় অনুমতি চাওয়া জরুরী নয় যখন কারো বাড়ীতে হঠাৎ কোন বিপদ দেখা দেয়। যেমন, আগুন লাগে অথবা চোর-ডাকাত ঢোকে। এ অবস্থায় সাহায্য দান করার জন্য বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা যায়।
পাঁচ : প্রথম প্রথম যখন অনুমতি চাওয়ার বিধান জারি হয় তখন লোকেরা তার নিয়ম কানুন জানতো না। একবার এক ব্যক্তি নবী সা. কাছে আসে এবং দরজা থেকে চিৎকার করে বলতে থাকে আমি কি ভেতরে ঢুকে যাবো? নবী সা. বাদী রওযাহকে বলেন, এ ব্যক্তি অনুমতি চাওয়ার নিয়ম জানে না। একটু উঠে গিয়ে তাকে বলে এসো, ‘আসসালামু আলাইকুম, আমি কি ভেতরে আসতে পারি?’ বলতে হবে। (আবু দাউদ) অনুমতি চাওয়ার সঠিক পদ্ধতি ছিল, মানুষ নিজের নাম বলে অনুমতি চাইবে। হযরত ওমর (রা.) ব্যপারে বর্ণিত আছে, নবী সা. খিদমতে হাজির হয়ে তিনি বলতেন: ‘ আসসালামু আলাইকুম, হে আল্লাহর রাসুল! উমর কি ভেতরে যাবে? (আবু দাউদ)
অনুমতির জন্য নবী সা. বড় জোর তিনবার ডাক দেবার সীমা নির্দেশ করেছেন এবং বলেছেন যদি তিনবার ডাক দেবার পরও জবাব না পাওয়া যায়, তাহলে ফিরে যাও। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ) তিনবার পরপর ডাকা উচিৎ নয় বরং একটু থেমে থেমে হতে হবে।
ছয় : গৃহমালিক বা গৃহকর্তা অথবা এমন এক ব্যক্তির অনুমতি গ্রহণযোগ্য হবে যার সম্পর্কে মানুষ যথার্থই মনে করবে যে, গৃহকর্তার পক্ষ থেকে সে অনুমতি দিচ্ছে। যেমন, গৃহের খাদেম অথবা কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। কোন ছোট্র শিশূ যদি বলে এসে যান, তবে তার কথায় ভেতরে যাওয়া ঠিক নয়।
সাত : অনুমতি চাওয়ার ব্যাপারে অযথা পীড়াপীড়ি করা অথবা অনুমতি না পাওয়ায় দরজার ওপর অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জায়েজ নয়। যদি তিনবার অনুমতি চাওয়ার পর গৃহকর্তার পক্ষ থেকে অনুমতি না আসে বা অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়, তাহলে ফিরে যাওয়া উচিৎ। এ জন্য নারাজ হওয়া বা মন খারাপ করা উচিৎ নয়। কোন ব্যক্তি যদি কারো সাথে দেখা করতে না চায় তাহলে তার এটি করার অধিকার আছে। অথবা কোন কাজে ব্যস্ত থাকার কারনে সে অক্ষমতা জানিয়ে দিতে পারে। ফকীহগণ আয়াতে ‘ফিরে যাও’ এর হুকুমের এ অর্থ নিয়েছেন যে, এ অবস্থায় দরজার সামনে গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই বরং সেখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ। অন্যকে সাক্ষাত দিতে বাধ্য করা অথবা দোর গোড়ায় তাকে বিরক্ত করা অধিকারে হস্তক্ষেপ করার শামিল।
আট : কারোর শূন্য গৃহে প্রবেশ করা জায়েজ নয়। তবে যদি গৃৃৃৃহকর্তা নিজেই প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে থাকে, তাহলে প্রবেশ করতে পারে। যেমন গৃহকর্তা বলে দিয়েছে যদি আমি গৃহে না থাকি, তাহলে আপনি আমার কামড়ায় বসবেন। অথবা এ ধরনের অনুমতি যে আমি আসছি, আপনি বসেন। তবে নিম্নলিখিত স্থানে প্রবেশের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই, যেমন, হোটেল, সরাইখানা, অতিথিশালা, দোকান, মুসাফির খানা ইত্যাদি।
আমরা এ নির্ধারিত সীমারেখার ভেতর যদি চলতে পারি, তাহলে সামাজিক শান্তি, শৃংখলা ও সম্প্রীতি ফিরে আসবে এবং আমরা একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ উপহার হিসাবে পাবো। আল্লাহ তা’আলা বলেন: ‘এটিই তোমাদের জন্য বেশী শালীন ও পরিচ্ছন্ন পদ্ধতি’ (সুরা নুর : ২৯) আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এ শালীন ও পরিচ্ছন্ন পদ্ধতি পালন করার তাওফীক দিন।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বৃষ্টির বাধায় বুলাওয়ে টেস্ট
হাটহাজারীতে ইটভাটায় অভিযান দুই লক্ষ টাকা জরিমানা
ইসলামী আন্দোলন নেতা আলতাফ হোসাইনের বড় ভাইয়ের ইন্তেকালে ঢাকা মহানগর নেতৃবৃন্দের শোক
রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফার মাধ্যমে আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারব : আমিনুল হক
ইসলামী আন্দোলন নেতা আলতাফ হোসাইনের বড় ভাইয়ের ইন্তেকালে ঢাকা মহানগর নেতৃবৃন্দের শোক
বিশ্বনাথে কানাডা প্রবাসীকে মোবাইল ফোনে চাঁদা দাবি : না দিলে হত্যার হুমকি
মেহেরপুর জেলা বিএনপির নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্বে বিভিন্ন গ্রামে ৩১দফা দাবি নিয়ে লিফলেট বিতরণ
সালথা উপজেলা পরিষদ কোয়ার্টারে দিন-দুপুরে দুর্ধর্ষ চুরি
৭ মাসেও মালয়েশিয়াগামী কর্মীরা টাকা পাসপোর্ট ফেরত পায়নি প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে অসহায় কর্মীদের অবস্থান
এবি পার্টির কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন -ভোট গণনা শেষে রাত আড়াইটায় ফলাফল ঘোষণা
একদিন এগিয়ে ৩ জানুয়ারি সমাবেশ করবে ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা
বিয়ের সময় বউকে সাজিয়ে স্টেজে সবার সামনে বসিয়ে রাখা প্রসঙ্গে?
কিশোরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলায় একজন গ্রেফতার
কাপ্তাই হাতি মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে ইআরটি সদস্যদের নিয়ে মতবিনিময় সভা
যুবকদের ভোটার তালিকায় আনতে চাই : সিইসি
অ্যামবুলেন্স ও সিএনজি মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত এক আহত ৫
ক্রীড়াঙ্গনে ২০২৪ সালের প্রভাবশালী নারী ব্যক্তিত্ব যারা
অ্যামবুলেন্স ও সিএনজি মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত এক আহত ৫
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নেই
নিজ এলাকায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত হলেন হারিস চৌধুরী